i.
শাস্ত্রে বিজ্ঞজনেরা লিখেছিলেন আশি তে আসিও না| “কাশী তে কাশিও না” লেখা টা এড়িয়ে যাওয়া টা যুক্তিসঙ্গত কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ| তবে আজকাল কাশী তে নামলে ধুলোর চোটে বিষম, কাশি, নাক চুলকানি এসব গুলো প্রসাদসম, না চাইলেও খেতে হয়|
ii.
কাশী পৌঁছে ছিলাম ঘন্টা বারোর ট্রেন যাত্রার পর| প্রথম দর্শনে স্টেশন ঘেঁষা কাশী কিন্তু বারানসি নয়| বরং আর্থ-নাগরিক দিক দিয়ে আর পাঁচটা তথাকথিত হিন্দি প্রধান শহরের সাথে নিজের অস্তিত্ব মিলিয়ে মিশে এক বেঞ্চে বসার চর্বিতচর্বণ প্রচেষ্টা| লালচে বাদামি রঙের ওপর এক ছাইদানি ছাই ঘষে দিলে যেরকম মনখারাপি রং হবে, প্রাথমিক ভাবে কাশী সেরকমই মলিন| আর তার মাঝেই চার দিক দিয়ে বেরিয়ে আসছে পোস্টারে পোস্টারে মোদী জির হাসি মুখ| একদিকে উড়ালপুল তৈরির ধুলো ধোঁয়া আর অন্যদিকে স্বচ্ছ ভারতের প্রচারের এই ব্যাঙ্গাত্মক সহাবস্থান| শুরুর শুরু টা হয়েছিল এভাবেই|
কিছুটা নিরাশা সাথে করে নিয়েই টোটো করেছিলাম, গোদৌলিয়া মোর যাবার জন্ন্যে| দ্রষ্টব্ব্য, গোদৌলিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, দশাশ্বমেধ ঘাটের আগের শেষ বড় চৌরাস্তা| প্রাক্তনীদের কাশী শুরু হয় কিন্তু এই চৌরাস্তা থেকেই|জোট কেটেছিল অনেক টা পর যখন অনেক টা শহর কাটিয়ে গঙ্গার কাছে এসে পৌঁছেছিলাম| গরু (বিশাল শিংওলা, পূর্ব ভারত আর পশ্চিম ভারত এর তফাৎ সৃষ্টিকারী বিষয়ে, পুং-জননেন্দ্রিয়ের প্রতীকীবাদ টুকু নাহয় বাদ-ই দিলাম), গোবর, ফেলুদার সিনেমায় দেখা অলি-গলি পাকস্থলী, কচুরি-চাট-পানের দোকান, মন্দির গুলোর বাড়বাড়ন্ত আর ধর্মের আস্ফালন টা দেখে চিনতে পারলাম, ঠিক জায়গা তেই এসেছি|
iii.
যত গঙ্গার কাছে এগিয়ে গেছি, শহরের প্রাচীন সত্তাটা তত গভীর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে| ধূসরের বদলে তখন আধিক্যতামাটে হলদেটে রঙের ওপর লাল, (এই লালের অনেক টাই এসেছে পানের পিকের নিরলস চেষ্টায়| কাশী তে যত পানের দোকান আছে, ঠিক ততটাই তার রঞ্জন বৈচিত্র) হলুদ, কমলার| ধুলো আর ধোঁয়ার সাথে তখন গরু, গোবর, দুধ আর রাবড়ির গন্ধ মিশিয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয়র ওপর এমন এক ব্যঞ্জনা, যেটা হয়তো আসল কাশী কে ফুটিয়ে তোলে| তার মাঝে বিভিন্ন রকম মানুষের একে অপরকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বাঁচার চেষ্টা| উত্তর প্রদেশের অত গভীরেও যে এতো টা বাঙালিয়ানা থাকতে পারে, সেটা ছোটবেলার গল্প গুলো না পড়া থাকলে, বিশ্বাস করা উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারতাম না| কিন্তু যেটা জানতাম না সেটা হলো এই ঘোর হিন্দুয়ানার বৈপরীত্য হিসেবে, তার পাশেই, একসাথেই রয়েছে ঘোর মুসলিম সম্প্রদায়| পাশ্চাত্যের বিদেশিরা থাকবে জানতাম, কিন্তু হিসেবের বাইরে গিয়ে দেখেছি প্রচুর জাপানি ভ্রমণকারীদের| সবাই আছে সবাই কে নিয়ে | বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন কর্মের লোকজন আছেন, বাকিদের জীবনে নাক না গলিয়েই| নিজের মতো করে থাকার থেকেও কাশীর মতো করে থাকার প্রবণতা টা বেশি করে চোখে পড়লো|
Also read: Varanasi: A Photo Essay
iv.
ধর্মপ্রাণ নই, কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছিলাম মন্দির গুলোতে| ধর্মবিশ্বাসের থেকেও, এই শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আবহর মিশেল খুঁজে পাওয়ার তাগিদ তাই আমাকে পৌঁছে দিয়ে ছিল কাশী বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা মন্দিরের গর্ভগৃহ পর্যন্ত| উন্মাদনা দেখেছি, আবার প্রচন্ড দারিদ্র, অসহায়তায় চোখে পড়েছে| একদিকে দেখেছি মূর্তি পূজার অনুষঙ্গ হিসাবে হাজার হাজার টাকার অপচয়| ধর্মীয় আড়ম্বরের মাঝে কত দুধ কলা ফল মূল পচিয়ে ফেলে নষ্ট হচ্ছে| অনন্য দিকে অগুন্তি না খেতে পাওয়া মানুষ বসে আছে মন্দিরের চারপাশে, ধার্মিকদের দেওয়া ভিক্ষার আশায়| যারা মন্দিরে যাচ্ছেন তাদের হয়তো ধর্ম আছে, কিন্তু যাদের পেটে খিদে আছে তাদের কাছে বোধহয় অন্ন সংস্থান তাই প্রধান পূজ্য| প্রসঙ্গত, কাশী তে বাঙালি বিধবাদের আধিক্যও কিন্তু কমেনি| সর্বসমক্ষে সবসময় তাদের দেখা পাওয়া না গেলেও, বাঙালির বানপ্রস্থ যে বেনারসে, সে কথার সত্যতা তারা নিজেদের শেষ বেলার জীবন টা বিলিয়ে দিয়ে এখনো বজায় রেখেছেন|
Also read: Field Notes: Darjeeling
v.
আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম যে কাশী শহর টা ঠিক এক মাত্রিক নয়। দেখতে গেলে, কোনো শহরই একমাত্রিক নয়, কিন্তু কাশী তে বহুমাত্রিকতা টা ততই প্রকট হয় যত গঙ্গা এগিয়ে আসে, এবং চোখ কান নাক খোলা রাখলে সম্পূর্ণ পরিবর্তন টা চোখে পড়তে বাধ্য। আধুনিক কাশী, পুরাতন কাশী পেরিয়ে গিয়েও গঙ্গাবক্ষের কাছে এসে আমি পৌঁছে গেছিলাম কাশী প্রাচীনতার সান্নিধ্যে। এখানে সময় শান্ত, ইতিহাস চিরজাগ্রত এবং আমাদের জাগতিক জীবনের অস্তিত্ব নগণ্য। বিশালের সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা চিনতে শেখা একইসাথে ভয়াবহ এবং সমীহ উদ্রেগকারী, আর হয়তো আমাদের সকলের জন্যেই তা বেশ প্রয়োজনীয়ও বটে।
কাশীর ঘাট গুলি দিয়ে, গঙ্গা কে পাশে রেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্ন্যে সবচেয়ে ভালো সময় কিন্তু ভোরবেলা। যে কোনো ধর্ম কেন্দ্রীক শহরের আত্মিক বৈশিষ্ট্য গুলো ফুটে ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ শুরু হয় ভোর ৪ টে নাগাদ। যত ভক্তি-প্রবল জায়গা, তত সূর্য-নমস্কারী আর পাপ স্খলনকারীদের প্রাতরাশ-পূর্ব কর্ম যজ্ঞ হলো এই সময়ে সারা দিনের পুণ্য সঞ্চয় করা। যত আলো ফোটে, তত রং রস গন্ধের সমারোহে কাশী নিছক একটা স্থান হওয়া ছেড়ে দিয়ে আধ্যাত্মিকতা কে আপন করে নেয়।
vi.
গেরুয়া শাসিত হলেও ঘাটে দৌরাত্ম্য কিন্তু লাল কৌপিন ধারী বাবাদের। কেউ কেউ আপনভোলা, কেউ কেউ গাঁজা ভাং এর জোরে সিদ্ধি লাভ করেছেন আর কেউ কেউ রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে গল্প জুড়তে পারেন, আশীর্বাদ পাবেন না অভিশাপ সেটা আপনার কপালের জোর। কপাল ভালো থাকলে বাবার প্রসাদ ও মিলতে পারে ছিলিম ভরে।
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলে, স্বেচ্ছায় গলি ঘুঁজি গুলো তে হারিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চ হাতে নিয়ে কাশীর রহস্য উন্মোচনে মত্ত হওয়াও কিন্তু এক ধরনের নেশা। শুনেছি নিষিদ্ধপল্লি গুলোর বাড়বাড়ন্তের দিক দিয়ে এই শহর টি দেশের প্রথম সারি তে বসার দাবিদার। নিদেন চুরি ডাকাতি খুন খারাপির বাজারও নাকি মন্দ নয়। সৌভাগ্যক্রমে, ভাগ্য সদয়। পকেটমারি বা প্রাণসংশয়, এই যাত্রায় একটিও হয়নি।
vii.
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেছিলাম। বহু লোকের আনাগোনা ঠেলে। ঘাটের ভিড়ের থেকেও গঙ্গা তে স্নান রত জনসংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের কেউ কেউ দেখলাম মন্দিরের পুজো শেষে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে পুজোর যজ্ঞের সামগ্রী। স্থানীয় বাচ্চারা ওৎ পেতে আছে, সেই ভাসিয়ে দেওয়া জিনিস গুলো তুলে এনে অন্য কোথাও বেচে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে। দেখে মনে হলো এটাই আসল বিসর্জন, দেবলোকের যন্ত্রপাতি গঙ্গায়ে ডুবে নিমেষে শুধুই বস্তু দ্রব্য হয়ে উঠলো। আরো খেয়াল করলাম যে যতটা নোংরা হওয়ার কথা, ঘাট গুলো তার থেকে অনেক পরিষ্কার। হয়তো স্বচ্ছ ভারত এর ইতিবাচক সারা কিছুটা হলেও মানুষ জন দিয়েছে। রোদ বাড়লো, আমিও হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম কাশীর বার্নিং ঘাটে।
মৃত্যু আর মৃত্যু প্রসঙ্গ হটাৎ করে মানুষ কে শান্ত করে দেওয়ার স্পর্ধা রাখে। ব্যতিক্রম হতে পারিনি, মাঝ দুপুরের আবহ তেও শ্মশান সংলগ্নতা আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম কাঠের চিতার ওপরে কারো স্বর্গ লাভ, কারো নরক গমন। প্রশ্ন উঠেছিল, এই এক রাত এক দিনের চেনা শহরে, যেখানে কয়েক পরত আধুনিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাচীন এক সত্তা, সেই প্রাচীনতার মাঝে আমাদের ক্ষণস্থায়ী মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব কতটা আর তার দামই বা কতটা। পাল্টা প্রশ্ন উঠেছিল, এই রীতি নীতির সংস্কারের ধারক আর বাহন যখন আমরা, তখন আমাদের বাকি রেখে এই শহর টুকুর ই বা অস্তিত্ব কি।
viii.
শাস্ত্রে বিজ্ঞজনেরা সত্যি সত্যি লিখেছিলেন “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর”। বেনারস আমার সাথে তর্ক করেনি, বেনারস আমার বিশ্বাসবোধের ওপরে অনুপ্রবেশও ঘটাতে পারেনি। কিন্তু ওই অল্প সময়ের মধ্যেও, বেনারস আমাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে পারিপার্শ্বিকের রসস্বাদন করতে শিখিয়েছে। আর শিখিয়েছে ভাবতে। আস্কারা দিয়েছে, জীবনের প্রতি করা নিজের প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে বার করতে।
In our Field Notes series, we will share our observations, reflections and afterthoughts on the places we visit. Some of these will be in Bengali, some in English. Two Bangali Backpackers aims to be a bilingual blog. Since our love for travel was stroked by various travelogues we read in Bengali magazines like Saptahik Bawrtoman, Bhromon Songee, etc. it is only natural that we love to share our stories with you in the language of home, of belonging, of nostalgia.
Have you been to Kashi? What are your thoughts?
Leave a Reply